অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত
স্রোতের বিপরীতে আর কোন লিখা লিখব
না বলে প্রতিজ্ঞা করতে করতে প্রতিদিন ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু পারি না সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা
করতে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে প্রতিজ্ঞা ভুলে যাই। যখন চোখের সামনে স্রোতের বিপরীতের
কোন না কোন বিষয় ভেসে উঠে। ফলে সকল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে আবারো সে বিষয়ে লিখতে চেষ্টা
করি। ফেসবুক অথবা ব্লগ পোষ্টের মাধ্যমে তা আবার জন সম্মূখে প্রকাশ করি। আর দুরু দুরু
বুকে অবলোকন করতে থাকি পাঠকের প্রতিক্রিয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখে
অবাক হয়ে যাই।
আসলে তারা পাঠক নাকি কোন মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর
সদস্য? তা না হলে একটি লিখার প্রতিবাদে কোন পাঠক কি একজন লেখককে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ,
শারীরিক ভাবে আহত করা, এমন কি হত্যা করার হুমকি দিতে পারে? শুধু অনলাইন মিডিয়ায় মন্তব্যের
মাধ্যমেই নয়, লেখককে ফোন করে হত্যার হুমকি দেয়াও যেন এখন তাদের জন্য আর্টে পরিনত হয়েছে।
উপরোক্ত প্যারাটি লিখার পটভূমি হলো
গত ১৫ অক্টোবর ২০১৭ ইং তারিখে “সমকামী সাজ্জাদের
মৃর্ত্যুর জন্য দায়ী কে?” একটি লিখা অনলাইন নিউজ মিডিয়া পরিবর্তন ডট কম সহ সামহোয়ার-ইন-ব্লগ ডট নেট,
ইস্টিশন ডট কম এবং শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম এ প্রকাশিত হয়।
লিখাটিতে
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা শহরে বসবাসরত সদ্য কলেজ শিক্ষা সমাপ্তকারী এক সদা
হাস্যজ্জল সমকামী তরুণের করুণ মৃর্ত্যুর কথা বলা বলেছিলাম। যে কিনা সমকামী হওয়া
স্বত্ত্বেও কিছুদিন আগে শুধুমাত্র পরিবারের চাপে বিয়ে করে বাসর রাতেই আত্মহত্যা করেছে।
শুধু যে সাজ্জাদ একাই নয়, সাজ্জাদের মত অনেক সমকামী ছেলে-মেয়ে যে সমকামী হওয়া সত্ত্বেও পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রের চাপে
বিপরীত লিঙ্গের ছেলে মেয়েকে বিবাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। যাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা
করে নিজেদের মুক্ত করছে, আর যারা পারছে না তারা শত কষ্টে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিপরীত লিঙ্গের
ছেলে মেয়ের সাথে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে মর্মে লিখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। পাশাপাশি
সাজ্জাদের এরকম করুণ মৃর্ত্যুর জন্য দায়ী কে? তার পরিবার, এই সমাজ নাকি প্রচলিত রাষ্ট্র
ব্যবস্থা? সেই প্রশ্ন জাতির বিবেক নিকট ছুড়ে দিয়েছিলাম। সর্বোপরি, সমকামীদের
স্বাভাবিক মানুষের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখানোর ব্রত নিয়ে সবাই
মিলে সমকামীদের অপরাধীর চোখে না দেখে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত তাদের সাথে
নিয়ে সবার জন্য বসবাসযোগ্য একটি মানবিক পৃথিবী গঠনে অগ্রসর হওয়ার আহবান জানিয়ে লিখাটি্র
সমাপ্ত টেনেছিলাম।
লিখাটি পরিবর্তন ও ইস্টিশন তাদের ফেসবুক পেইজেও
একইদিন পোষ্ট করেছিল। লিখাটি অসংখ্যবার পঠিত
ও শেয়ার হয়েছে, এমনকি লাইকও পেয়েছে সহশ্রাধিক। লিখাটি প্রকাশের পর দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত
অসংখ্য প্রগতিশীল বাঙ্গালী পাঠকের অভিনন্দন পেয়েছি। যাদের অনেকেই সমকামী, অনেকেই উভকামী
আবার অনেকে বিষমকামী নারী ও পুরুষ। অনেক সমকামী লিখাটি তাদের মনের কথা বলে ব্যক্ত করেছে।
অনেকে তাদের মনের কথাগুলো এভাবে ফুটিয়ে তোলায় আমাকে ধন্যবাদ এবং আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা
জানিয়েছে। আবার অনেকে তাদের মনের মাঝে জমে থাকা কষ্টগুলো আমার নিকট শেয়ার করে নিজেদের
হালকা করার প্রয়াস চালিয়েছে। যাদের মধ্যে দেশের অনেক প্রতিষ্টিত এবং খাতিমান চেনা মুখও
রয়েছে।
অনেকেই লিখাটির সমালোচনা করেছে। কেউ কেউ গঠনমুলকভাবে
আবার অনেকে ইচ্ছেমত সমালোচনা করেছে। অনেকে আবার আমাকে সমকামী হিসেবে চিহ্নিত করে ইচ্ছেমত
গালিগালাজ করে দেশ থেকে বহিষ্কার করার হুমকি দিয়েছে। আবার কেউ কেউ আমাকে ইসলামের শত্রু
হিসাবে বর্ননা করে আমাকে কাছে পেলে উত্তম মধ্যম প্রদানের হুমকি দিয়েছে। আবার কেউ কেউ
আমাকে পুড়িয়ে মারারও হুমকি দিয়েছে। আবার কেউ আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার জন্য আহবান
করেছে। শুধু আমাকে নয় দেশের সকল সমকামীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছে কেউ
কেউ। আবার লিখাটি প্রকাশের জন্য পরিবর্তনের
অ্যাডমিনকেও কেউ কেউ হুমকি প্রদান করেছে। কেউ কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে
পরিবর্তনের মত নিউজপোর্টাল আমার লিখাটি প্রকাশ করতে পারে। তাই অনেকে আর পরিবর্তন
নিউজ পোর্টালটি ভিজিট করবেন না বলেও জানিয়েছে। শুধু সোস্যাল মিডিয়ায় হুমকি দিয়ে
তারা ক্ষান্ত হন নি, লিখাটি প্রকাশের জন্য আমাকে মোবাইলে হত্যারও হুমকি দিয়েছে।
যে কোন বিষয়ে যে কেউ সমালোচনা করতে পারে বা তার প্রতিবাদ করতেই পারে। সমালোচনা
করা বা প্রতিবাদ করার সুযোগ পাওয়াটাও একটি
অধিকার। কেউ কারো নিকট থেকে সে অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। তবে সে সমালোচনা হতে হবে
গঠনমূলক, সে প্রতিবাদ হতে হবে শান্তিপূর্ণ। সমাজে বসবাস করতে গেলে যে সবার মতামত
সবার ভাল লাগবে অথবা সবার মতাদর্শ সবায় মেনে চলবে তাতো নয়। ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের
সমন্বয়ে সভ্য সমাজ এগিয়ে যাবে। ভিন্ন মতাদর্শ বা ভিন্ন মতাদর্শের লিখার সমালোচনা
হবে, প্রতিবাদ হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভিন্ন মতাদর্শ বা ভিন্ন মতাদর্শমূলুক লিখার সমালোচনা হিসাবে বা প্রতিবাদ
হিসাবে যখন কাউকে অবর্নণীয় ভাষায় গালিগালাজ করা হয় বা ব্যক্তিগতভাবে আক্রমনের
হুমকি দেয়া হয় বা হত্যার হুমকি প্রদান করা হয় তখন আর তা সমালোচনা বা প্রতিবাদের মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকে না, তখন তা অপরাধে পরিনত নয়। তাই সকলের প্রতি আহবান, ভিন্ন মতাদর্শমুলক
লিখার প্রতিবাদ যুক্তি নির্ভর লিখনি দিয়েই হোক, হত্যার হুমকি দিয়ে নয়।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও
ব্লগার; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড, ইমেইল: saikotbihr@gmail.com, মোবাইল: ০১৭২০৩০৮০৮০।
No comments:
Post a Comment