Friday, August 29, 2014

কন্যা শিশুর বৈষম্যহীন সমঅধিকার ও সমসূযোগ নিশ্চিত কর

অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত: বরগুনা সদর উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র কৃষকের মেয়ে লতিফা বেগম (ছদ্দনাম)। দশ বছর আগে মাত্র তের বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল একই গ্রামের দিনমজুর কালামের সাথে। বিয়ের দুই বছর পর লতিফা বেগমের এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু পরিবারের
সবার আশা ছিল পুত্র সন্তানের। পুত্র সন্তানের আশায় তিন তিন বার সে গর্ভ ধারণ করে এবং তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে স্বামী, শাশুরী, ননদ, দেবর প্রায়শ তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। একদিন লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে তারা লতিফাকে।

তারপর সে তিন কন্যাকে সাথে নিয়ে নিজের ঘর সংসার ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। লতিফা বেগমের পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগ করছে তার ভাইয়েরা। কিন্তু ভাই-ভাবীর সংসারে কিছু দিন থাকার পর লতিফা বেগম  বুঝতে পারে তাদের সংসারে তিনি কতটা অসহায় ও অবহেলিত। খেয়ে না খেয়ে অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে ভাই-ভাবীর খোটা, পাড়া-পড়শীর ফিসফিসানিতে অস্থির হয়ে লতিফা বেগম বহুবার স্বামীর সংসারে ফিরে যেতে চেয়েছে। কিন্তু পুত্র সন্তান জন্মদানের নিশ্চয়তা তো সে দিতে পারে না। তাই স্বামীর সংসারেও তার যাওয়া হয়না। স্বামী ও শ্বাশুড়ি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের বাড়িতে লতিফা বা লতিফার তিন কন্যার কোন স্থান নেই।


এই ঘটনাটি শুধু একমাত্র লতিফা বেগমের নয়। এটি আমাদের সমাজের এক করুন এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতার চিত্র। এরকম অনেক লতিফা রয়েছে যারা অভাবের সংসারে নিজেদের শিশু জীবন বিসর্জন দিয়ে বরণ করে নিয়েছে বাল্যবিবাহের অভিশাপ। উপরন্তু কন্যা সন্তানের জন্মদান তাদের জীবনকে আরো নাজুক করে তুলেছে। বিশ্বের অনেক দেশের মত আমাদের সমাজেও মেয়ে সন্তানের চেয়ে ছেলে সন্তান আকাঙ্খিত। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে কথা নেই, সব সংসারেই কন্যা শিশুর জন্ম এক নিরানন্দের বিষয়। প্রথমটি মেয়ে হলে পরের সন্তানটি অবশ্যই ছেলে হতে হবে এই আকাঙ্খা থাকে পরিবারের সবার।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত ও জাতির কর্ণধার। শিশুরা বড় হয়ে একদিন দেশ গড়বে, হোক না সে পুরুষ শিশু হোক অথবা কন্যা শিশু। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কন্যা শিশুরা সবদিক দিয়ে বৈষম্যের শিকার। দরিদ্রতার প্রথম শিকার হয় কন্যা শিশুরা। দরিদ্র পরিবারের কন্যা শিশুরা গার্মেন্টস ও বাসা-বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। শ্রমজীবী শিশুদের মধ্যে ২২ শতাংশ শহর অঞ্চলে কাজ করে এবং তাদের মধ্যে ১৯ শতাংশ কন্যা শিশু, যারা গৃহপরিচারিকার কাজ করে থাকে। কন্যা শিশুদের ক্ষেত্রে শিশু পাচারের শিকার হবার ঝুঁকি বেশী থাকে। পাচারকৃত কন্যা শিশুদের একটি বড় অংশকে যৌন বৃত্তিমূলক কাজেও ব্যবহার করা হয়।

পুষ্টিহীনতা, শিক্ষার অভাব, শিশু শ্রম, বাল্যবিবাহ এসবই কন্যা শিশুর প্রতি আমাদের এই সমাজের বৈষম্যমূলক আচরনের বহিঃপ্রকাশ। সংসারের শিশু এবং বয়স্কদের দেখাশুনার দায়িত্ব একক ভাবে মেয়েদের কাধে তুলে দেয়া হলেও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয় এবং সংসারে তাদের মতামতের কোন গুরুত্ব ও দেয়া হয়না। প্রথাগত রীতিনীতির বেড়াজাল ও ধর্মের আচ্ছাদনে মেয়েদেরকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, যা আসলে মেয়েদেরকে সমাজে অধঃস্তন করে রাখার একটি প্রক্রিয়া মাত্র।

শিশুকাল থেকেই কন্যাশিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যাতে করে তারা প্রতিবাদী হতে না শেখে। তাদের প্রতি করা বৈষম্যমূলক আচরণকে অন্যায় হিসেবে না দেখে বরং সহজাত ও সমঝোতার সাথে গ্রহন করতে শেখানো হয়। যা পরবর্তীতে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার পথকে প্রশস্ত করে। তাই নারীর প্রতি সকল প্রকার অন্যায় ও সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত কন্যা শিশুদের ক্ষেত্রে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য রোধ করা এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন হওয়া।

শিশু বিবাহ নারীর প্রতি বৈষম্য ও নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের ৬৮ শতাংশ মেয়ে শিশু বিবাহের শিকার এবং শিশু বিবাহের শিকার মেয়েদের মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ মেয়ে বিবাহ পর্বরতী সময়ে লেখা পড়া চালিয়ে যেতে পারে। অবশিষ্ঠাংশ লেখা পড়ার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে স্বামী সেবার কাজে নিয়োজিত হন এবং একসময়য় শিশু মায়ে পরিণত হন। এমনকি একসময়য় সন্তান জন্ম দানকালে মৃর্ত্যু মুখে পতিত হন অথবা রুগ্ন, স্বাস্থ্যহীন ও পুষ্টিহীন আরেক শিশুর জন্ম দেন। ফলে তাদের একদিকে নিজেদের বিকশিত করার সূযোগ এবং অন্যদিকে সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রাপ্তি থেকে জাতিকে বঞ্চিত করা হ।

শিশু অধিকার রক্ষাকল্পে ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক এক প্রস্তাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর একদিন ‘শিশু দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর ‘শিশু অধিকার দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। কন্যা শিশুর প্রতি জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য রোধে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ২০০০ সালে  তৎকালীন সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি সরকারি আদেশের মাধ্যমে শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনকে কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালনের  লক্ষ্যে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। তখন থেকেই প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে। 

কন্যা শিশুর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ ও তাদের প্রতি বৈষম্যহীন আচরনের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়কে সামনে রেখে আজ ৩০ শে সেপ্টেম্বর সারাদেশে বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানমালা আয়োজনের মাধ্যমে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে দিবসটি উদযাপন করতে সচেষ্ট রয়েছে। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় “শিশু কন্যার বিয়ে নয়, করবে তারা বিশ্ব জয়” কে সামনে রেখে বলতে চাই যে, বাংলাদেশে দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ শিশু ও নারী। এই নারী ও শিশুর উন্নতি জাতীয় উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কন্যা শিশু ও নারীদের অধিকার অর্জিত হলে মানব সম্পদ উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যাবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। তাই কন্যা শিশু, পুরুষ শিশু, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল শিশুর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ। আর সেই পরিবেশ তৈরীর জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলকে সচেতন হতে হবে এবং সম্মিলিত ভাবে কাজ করে যেতে হবে।

সর্বোপরি, শিশু বিবাহ বন্ধ করে শিশু কন্যাদের প্রতি বৈষম্য ব্যতীত সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান করা হলে ওরা নিজেদের বিকশিত করে অবশ্য অবশ্য একদিন বিশ্ব জয় করবে। তারা একদিন মাদার তেরেসা, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়া, নিশাত মজুমদার, ওয়াজফিয়া'র সমপর্যায়ে যেতে পারবে। মনে রাখতে হবে আজকের শিশু কন্যা আগামী দিনের একজন মহিয়সী নারী।

লেখক: অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত; মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ডস; একটি শিশুকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত; মোবাইল: ০১৭২০৩০৮০৮০; ইমেল:saikotbihr@gmail.com; ব্লগ: www. shahanur.blogspot.com

লিখাটি নিম্নোক্ত নিউজ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে:



3. জাতীয় কন্যা শিশু দিবস: কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, PrimeNewsBD24.com, September 30, 2013

4. জাতীয় কন্যা শিশু দিবস: কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, The Daily Sonar Alo, September 30, 2013

5. জাতীয় কন্যা শিশু দিবস: কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, BNC24.Net, September 30, 2013

6. জাতীয় কন্যা শিশু দিবস: কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, Gorai24.Com, September 30, 2013

7. জাতীয় কন্যা শিশু দিবস: কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, BDTomorrow.Net, September 30, 2013

8. শিশু কন্যার বিয়ে নয়, করবে তারা বিশ্ব জয়, Uttaradhikar71News.Com, September 30, 2013
‘শিশু কন্যার বিয়ে নয়, করবে তারা বিশ্ব জয়’


9. জাতীয় কন্যা শিশু দিবস: কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, banglasongbad24.com, September 30, 2013

10. জাতীয় কন্যা শিশু দিবস: কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, SatkhiraNews.com, September 30, 2013
‘শিশু কন্যার বিয়ে নয়, করবে তারা বিশ্ব জয়’

11. কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন সমসূযোগ ও সমঅধিকার প্রদান কর, BDEeuroNews.Com, September 30, 2013 

======================================================================  
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.