Saturday, December 20, 2014

কল্যাণমূলক নয়, অধিকার ভিত্তিক আইন চাই!

অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত: প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার বিষয়টি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের প্রেক্ষাপটে খুবই গৌণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অধিকারসমূহকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান না করে অনুগ্রহ প্রদানের দৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৮ মিলিয়ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বসবাস। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিশেষত অধিকাংশ প্রতিবন্ধী নারী ও কিশোরীরা সমাজের নিকট থেকে
নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হয়। রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে অবলোকন করে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশগত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা সমাজে আজ তাদের অরক্ষিত ও অবহেলিত শ্রেনীতে পরিনত করেছে। পরিবার থেকে রাষ্ট্র সকল স্থানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদ, বিশেষত ১০, ১১, ১৫,১৭,১৯,২০,২১,২৭,২৮,২৯,৩১,৩২,৩৬ নং অনুচ্ছেদ  সমতাপূর্নভাবে কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব বা বৈষম্য ব্যতীত সকল নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষার কথা উল্লেখ করছে। তবে সমাজের অনগ্রসর অংশের উন্নয়নের জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়নের কথাও সংবিধানে বলা হয়েছে।

ফলে সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সকল প্রকার মানবাধিকার, আইনগত অধিকারসহ মৌলিক স্বাধীনতা উপভোগের অধিকারী। অধিকন্তু, অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তি (বাংলাদেশ যেসব চুক্তির স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী সদস্য রাষ্ট্র) অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সকল ক্ষেত্রে সমঅধিকার ও সমসূযোগ পাওয়ার অধিকারী।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের ২৩ ধারা সকল প্রতিবন্ধী শিশুদের অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের মত সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারি হিসেবে ঘোষনা করেছে। আবার সিডও সনদ প্রতিবন্ধী নারীকে অন্যান্য নারীর মত সকল প্রকার বৈষম্যের হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করেছে।

পাশাপাশি জাতীয় শিশু নীতিমালায় প্রতিবন্ধী শিশুসহ সকল শিশুর অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে। আবার জাতীয় নারী নীতিমালা প্রতিবন্ধী নারীসহ সকল নারীর অধিকার সুরক্ষা প্রদান করেছে।

তারপরও এসকল আন্তর্জাতিক ও জাতীয় জাতীয় সনদ সুনির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। সেসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সনদে সাধারণভাবে সকল অধিকারের সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্ষিপ্তরূপে স্থান পেয়েছে।

২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধিদের অধিকার বিষয়ক একটি কনভেনশন গৃহীত হয়। যা ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়। উক্ত কনভেনশনের স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম সারির দেশ হিসেবে প্রতিবন্ধিদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশনটি বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশ সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

প্রতিবন্ধিদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশনের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিবন্ধিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র কি ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং ভবিষ্যতে গৃহীতব্য পরিকল্পনা উল্লেখপূর্বক একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিটির নিকট পেশ করতে হয়।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক অধিকাংশ আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহে বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষর করলেও তার অধিকাংশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতার আলোকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী নীতিমালা প্রণয়ন করে। এ নীতিমালার মাধ্যমে সরকার প্রথমবারের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের উন্নয়নের জন্য প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।

তারই ধারাবাহিকতায় ৪ এপ্রিল ২০০১ সালে জাতীয় সংসদে প্রতিবন্ধী কল্যান আইন পাশ হয় এবং একই বছরের ১ আগষ্ট থেকে তা কার্যকর হয়। উক্ত আইনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম জাতীয়ভাবে প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা নির্ধারণ ও তার শ্রেনী বিভাগ করা হয়।

উক্ত আইনে সমাজ কল্যান মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় সমন্বয় কমিটি, সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে জাতীয় নির্বাহী কমিটি এবং জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ৬৪টি জেলা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।

উক্ত আইন সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র প্রদানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে। যাতে করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উক্ত পরিচয় পত্র প্রদর্শন করে খুব সহজেই সরকারি ও বেসরকারী পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকার সেবা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পায়।

তবে বাস্তবে প্রতিবন্ধী কল্যান আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী গঠিত জাতীয় ও স্থানীয় কমিটি খুব সীমিত আকারে কার্যকর। এমনকি তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ভূমিকা সম্পর্কে যতেষ্ঠভাবে অবগত নয়।

জাতীয় শিক্ষা নীতিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যপারে জোড় দেওয়া হয়েছে। তারপরও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অংশ গ্রহনের হার খুবই সীমিত। অসাম্য শিক্ষা ব্যবস্থ্যা, অনমনীয় ও অবন্ধুসুলভ শিক্ষা পাঠ্যক্রম, অভিভাবকদের অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাব, শিক্ষকদের জ্ঞানের স্বল্পতাসহ অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবন্ধুসুলভ পরিবেশের কারণে প্রতিবন্ধী শিশুরা খুব কম শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ সংবিধানে যদিও শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে চাকুরী ক্ষেত্রে বৈষম্য করাকে নিশিদ্ধ করেছে। তারপরও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাকুরী পাওয়া অলীক স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার সকল চাকুরি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ও এতিমদের জন্য ১০% কোঠা নির্ধারণ এবং ক্যাডার সার্ভিসে ১% কোঠা নির্ধারন করলেও নিয়োগদাতার অবহেলা ও পরস্পর বিরোধী নিয়োগ নীতিমালা এবং সরকারের সঠিক তদারকির অভাবে সরকার নির্ধারিত কোঠা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলাদেশ বিল্ডিং কোডে ভবন ডিজাইনের ও নির্মানের সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে সহজে প্রবেশ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা প্রদান করেছে। কিন্তু সরকারের সঠিক মনিটরিং ও স্বদিচ্ছার অভাবে অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল সরকারী ও বেসরকারি ভবন ডিজাইন ও নির্মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে নির্দেশনা মানা হয় না।

চিত্ত বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। সাধারণত পার্ক, শিশু পার্ক, নাটক, সিনেমা হল, যাদুঘর, ঐতিহাসিক স্থানসমূহ বিনোদন স্থান হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হলেও এসব স্থানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা নেই বললেই চলে।

যাহোক, দেশে বিদ্যমান আইনসমূহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় পর্যাপ্ত নয়। অধিকাংশ আইনই কল্যাণমূলক, অধিকারমূলক নয়। তাছাড়া সেসকল ব্যক্তি আইন ও নীতিমালাসমূহ প্রয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা প্রায়শ বিষয়টি সম্পর্কে যতেষ্ঠ অবগত ও সচেতন নয়।

তাই নারী পুরুষ নির্বিশেষে পরিবার থেকে রাষ্ট্র সকল স্থানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধী অধিকার আইন প্রণয়ন পূর্বক তা কার্যকরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে একটি মানবিক সমাজ গঠন এখন সময়ের দাবী।

লেখক: মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও কলামিষ্ট; প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ;  মোবাইল: ০১৭২০৩০৮০৮০; ইমেইল: saikotbihr@gmail.com, ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com

নিবন্ধটি নিম্নলিখিত নিউজ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছেঃ




৪।প্রতিবন্ধীর অধিকার:শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, OpenNews24.Com, May 07, 2013

৫।প্রতিবন্ধীর অধিকার:শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, Gorai24.Com, May 07, 2013

৬।প্রতিবন্ধীর অধিকার:শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, BanglaNews.Com.Bd, May 07, 2013

৭।প্রতিবন্ধীর অধিকার:শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, 52Somachar.Com, May 07, 2013

৮।প্রতিবন্ধীর অধিকার:শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, CHTNews24.Com, May 07, 2013

৯। প্রতিবন্ধীর অধিকার:শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, SatkhiraNews.Com, May 07, 2013

১০। প্রতিবন্ধীর অধিকার:শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, Bangla.Se, May 08, 2013

 ১১। প্রতিবন্ধী অধিকার : শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, Bangla-News24.Com, May 10, 2013

 ১২। প্রতিবন্ধীর অধিকারঃ শুধু আইন প্রণয়ন নয়, চাই কার্যকর প্রয়োগ, PrimeNewsbd24.Com, May 10, 2013

======================================================================  
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.

No comments:

Post a Comment