অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত:পারুল আক্তার (ছদ্দনাম), দেশের একটি
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটি বিভাগীয় সদরের নিম্ন
আদালতে শিক্ষানবীশ আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস করছেন। একদিন রাতে হটাৎ করে কিছু থানা
পুলিশ তাঁর বাড়ীতে এসে তাকে ওয়ারেন্টমুলে
গ্রেফতার করে এবং বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক কারাগারে প্রেরণ করে (পরে তিনি জানতে পারেন যে, জমি জমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে একটি মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল)।
তিন দিন কারাগারে হাজত বাসের
পর তিনি জামিনে বেড় হয়ে আসেন। কিন্তু সে তিন দিন তাঁর জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে
নেয়। পুলিশ কর্তৃক গ্রফতার হয়ে আদালতে প্রেরণ এবং সেখান থেকে কারাগারে প্রেরণের
সময় থেকে জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুহুর্ত ও স্থানে তাকে
মোকাবেলা করতে হয় বিভিন্নরকম হয়রানী ও খারাপ পরিস্থিতির এবং সম্মুখীন হতে হয় হাজারো
বাজে অভিজ্ঞতার। শুধু পারুল আক্তার নয়, তাঁর মত হাজারো নারী কারাবন্দী
কারাগারগুলোতে প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে হয়রানী ও বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছে। গ্রেফতার করে এবং বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক কারাগারে প্রেরণ করে (পরে তিনি জানতে পারেন যে, জমি জমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে একটি মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল)।
সমগ্র বাংলাদেশ অবস্থিত ৬৮ টি কারাগারই নানা
সমস্যায় জর্জরিত। সরকার কারাগার ও কারাবন্দীদের জীবন মান উন্নয়নে পদক্ষেপ
গ্রহণে সর্বদায় কেন যেন উদাসীন। ব্রিটিশ আমলে তৈরী অধিকাংশ কারাগারের সেল, ওয়ার্ডগুলো খুব
ছোট ছোট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা
দুর্বল এবং বাতাস
চলাচলের অপর্যাপ্ততা লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ কারাগারে সারা বছর ধারণ ক্ষমতার
চেয়ে অনেক
বেশী বন্দীদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। তাছাড়া, নিম্নমানের খাবার সরবরাহ,
পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার অভাব,
অপরাধ প্রবণতা, বিভিন্ন
ধরণের রোগ-নো বিস্তার,
সহবন্দীদের দ্বারা হয়রানি ইত্যাদি বিষয়গুলো বাংলাদেশের কারা ব্যবস্থাপনাকে
ভঙ্গুর করে তুলেছে।
কারাগারসমূহে নারী কারাবন্দীরা পুরুষের তুলনায় আরো
বেশিমাত্রায় সমস্যার সম্মুখীন হয়। নারী কারাবন্দীদের জন্য শুধুমাত্র পৃথক সেলের
অপর্যাপ্ততায় নয়, পয়ঃনিষ্কাশন
ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থা লক্ষ করা যায়। তাছাড়া, নারী কারাবন্দিসহ মায়েদের সাথে অবস্থানরত শিশুদের স্বাস্থ্য
রক্ষার জন্য সঠিক পরিমানে খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা অপ্রতুলতা সহ শিশুদের জন্য বিশেষ
কোন সুবিধাদি এসব কারাগারে নেই।
কারাবিধির ১২৯ ধারা কারাবন্দীদের
ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দের কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবে অতিরিক্ত কারাবন্দীর অবস্থান যেন স্বাভাবিক
বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশিমপুর মহিলা কারাগারসহ সমগ্র দেশের কারাগারগুলোতে ২৩০০ জন
নারী কারাবন্দী অবস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৩০০০
জনেরও বেশী নারী কারাবন্দী
অবস্থান করছে। যার মধ্যে অধিকাংশ বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে।
তাছাড়া, অধিকাংশ নারী
কারাবন্দিদের সাথে রয়েছে তাদের শিশু সন্তান,
যার সংখ্যা এ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত নয়। নারী কারাবন্দীদের সাথে অবস্থানরত শিশু
সন্তানদের সংখ্যা যোগ করলে তা বর্তমান সংখ্যার চেয়ে অনেক বেরে যাবে তা বলার
অপেক্ষা রাখে না।
কারাগারে নারী কারাবন্দীদের তাদের
শিশু সন্তানের সাথে একত্রে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়। অনেক সময় পালাক্রমে ঘুমাতে হয়
এবং এমনকি কিছু কিছু সময় ঘুমানোর সুযোগও মেলে না। ফলে এমন অমানবিক বাসস্থানের
পরিস্থিতি শুধুমাত্র নারী কারাবন্দীদের নয়,
তাদের সাথে অবস্থানরত শিশু সন্তানের বেড়ে উঠার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কারাবিধি অনুযায়ী একজন কারাবন্দী প্রতিদিন ১৩৩.২৮ গ্রাম সবজি, ৭২.৯০ গ্রাম মাছ বা ৭৭.৯০ গ্রাম
মাংস এবং ১৪৫.৮০ গ্রাম ডাল পাওয়ার অধিকারী হলেও কতিপয়
অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেক কম পরিমান
খাবার সরবরাহ করে, যা তাদের প্রতিদিনের চাহিদা
মেটানোর জন্য খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া,
যে খাবার সরবরাহ করা
হয় তা খুবই নিম্নমানের।
যদিও কারাবিধি অনুযায়ী কারাবন্দীদের
বাহির থেকে খাদ্য সরবরাহ করা নিষিদ্ধ, তারপরও কতিপয় অসাধু কারা কর্মকর্তার যোগ
সাজসে অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তা করা হয়। এমন কি অবৈধ অর্থ প্রদান করলে ভাল
খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়।
কারাগারগুলোতে চিকিৎসা সেবা প্রদান
করা হয় না বললেই চলে। যেটুকু
প্রদান করা হয় তা খুবই নামেমাত্র আর প্রাথমিক পর্যায়ের। প্রয়োজনীয় ঔষধের অপর্যাপ্ত
সরবরাহ, সার্বক্ষণিক
চিকিৎসকের অভাব, কর্তৃপক্ষের
অবহেলা ও দূর্নীতি কারাগারে স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটিয়েছে।
অধিকাংশ অসুস্থ কারাবন্দীর চিকিৎসা সেবা পেতে খুব ঝামেলা পোহাতে হলেও বিত্তশালীরা
খুব সহজেই অসুস্থ না হওয়া সত্বেও কারা হাসপাতালের ওয়ার্ডে অবস্থান করার সুযোগ পায়।
কারাবিধির ৯৪ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক
কারাগারে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা
দেখা যায় না। যা খুবই উদ্বেগজনক। তাছাড়া, গর্ভবতী
কারাবন্দীদের মাসে দু’বার করে শারীরিক পরীক্ষা করার কথা কারা বিধিতে থাকেও
বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।
জীবাণুমুক্ত খাবার পানি কারাগারসমূহে
বন্দী নারী কারাবন্দীদের জন্য যেন অলিক স্বপ্ন। অন্যান্য কারাবন্দীদের মত তাদেরও
পাইপ লাইনে সরবরাহকৃত সাধারণ পানি পান করতে হয়, যে পানি সাধারণত প্রাত:কার্য শেষে
ব্যবহার করা হয়। তদুপরি,
স্যানিটারী ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
নারী কারাবন্দীদের জন্য পৃথক টয়লেটের
অপর্যাপ্ততার কারণে দীর্ঘ লাইন দিয়ে প্রাতঃকার্য সম্পন্ন করতে হয়। টয়লেটগুলো
প্রতিদিন নামে মাত্র পরিষ্কার করা হলেও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অধিকাংশ সময়
অস্বাস্থ্যকর ও ব্যবহার অনুপযোগী থেকে যায়।
সর্বোপরি, নারী কারা ইউনিট নারী
কারারক্ষীদের দ্বারা পরিচালনা করার কথা থাকলেও বাস্তবে নারী কারারক্ষীর স্বল্পতার
কারনে করা হয় না। ফলে, কারাগারে অবস্থানরত নারী কারাবন্দীরা নিয়মিত পুরুষ
কারারক্ষীদের দ্বারা যৌন হয়রানীর শিকার হয়, যা তারা প্রকাশ করতে পারে না। কারণ
প্রকাশ করলে তাদের জীবনে নেমে আসে অবর্নণীয় যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও কলামিস্ট;
প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব,
জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ;
মোবাইলঃ ০১৭২০৩০৮০৮০, ইমেল: saikotbihr@gmail.com, ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com
১২। নারী কারাবন্দী: মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, DailyTimes24.com, April 22, 2013
নিবন্ধটি নিম্নোক্ত নিউজ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছেঃ
১২। নারী কারাবন্দী: মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, DailyTimes24.com, April 22, 2013
১৪। কারাবন্দী নারী মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, Bangla.Se, April 19, 2013
১৫। নারী কারাবন্দী মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, SangbadSamoy24.Com, April 20, 2013
১৬। নারী কারাবন্দী মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, Bangladesh-web.com, April 20, 2013
১৭। নারী কারাবন্দী মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, OpenNews.Com, 19 April 20, 2013
১৮। নারী কারাবন্দী মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, NewsBd71.Com, 19 April 20, 2013
১৯। নারী কারাবন্দী মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, ProvatirAlo.com, 22 April, 2013
২০। নারী কারাবন্দী মানবাধিকার বিহীন মানবেতর জীবন, NewsfromBangladesh.net, 23 April, 2013
======================================================================
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.
No comments:
Post a Comment