Saturday, August 24, 2013

দলিত নারী: সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন প্রণয়ন জরুরী

অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত: শুধুমাত্র জন্মগত অথবা পেশাগত পরিচয়ের কারণে সামাজিকভাবে দলিত সম্প্রদায়ের মহিলাদের অবিচার ও অমানবিক আচরণের শিকার হওয়ার বিষয়টি অহরহ আমাদের চোখে পড়ে। কায়িক শ্রমনির্ভর,দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট এই জনগোষ্ঠী
ঐতিহ্যিকভাবে হিন্দু বা মুসলিম কিংবা বাঙালী বা অবাঙালী যা-ই হোন না কেন জ্ঞাতি সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধনের আওতায় সুদূর অতীতকাল ধরে এরা কিছু নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত। সমাজে যেহেতু তারা এখনো ‘অশুচি’ ও ‘অপবিত্র’ হিসেবে গণ্য হয়,তাই তারা তথাকথিত পবিত্র জনগোষ্ঠী বা ‘মূলধারার সমাজ’ হতে আলাদা স্থানে বাস করতে বাধ্য হয়। দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচে’ বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার দলিত নারীরা। তারা দু’ভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হন। প্রথমত,দলিত হিসেবে বৃহৎ সমাজে এবং দ্বিতীয়ত,নিজ সমাজে নারী হিসেবে। বাল্যবিবাহ এই জনগোষ্ঠীর জন্য এক সাধারণ সত্য। এ ছাড়া রয়েছে নারী হিসেবে তার সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল। এই জনগোষ্ঠীর নারীদের মধ্যে বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক চর্চা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। কোনো কারণে দলিত নারীরা স্বামী পরিত্যক্ত হলে বা বিধবা হলে সমাজে টিকে থাকা তাদের জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়ে।

সামাজিক বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতা বিরোধী কেনো আইন না থাকার কারণে জন্ম ও পেশাভিত্তিক বৈষম্যের শিকার এই দলিত জনগোষ্ঠী অস্পৃশ্যতার শিকার হলেও আদালতে যেতে পারে না। পাশাপাশি দলিত নারীদের বেশিরভাগই যেহেতু ধর্মগতভাবে হিন্দু এবং বিবাহ নিবন্ধনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে তারা ‘মূলধারার নারীদের তুলনায় আইনী সুরক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে আছে।

দলিত নারীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি তাদের বাসস্থান ও পয়:নিষ্কাষণ সুবিধার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দলিত জনগোষ্ঠীর লোকজন সাধারণত নোংরা পরিবেশে বাস করতে বাধ্য হয়। চরম দারিদ্র্য যেহেতু তাদের নিত্যসঙ্গী। উপরন্তু নারী হওয়ার কারণে পুরুষতান্ত্রিক চর্চাও তার দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হয়। তেমনি চিকিৎসা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী হওয়া একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে,যদি কেউ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যায়ও,অস্পৃশ্যতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হয়।

দলিত জনগোষ্ঠী রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও অন্যদের টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে অথচ পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাষণ সুবিধার অভাবে তাদের কলোনিগুলো থাকে সবচেয়ে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। মফস্বলে অস্পৃশ্যতার ধারণা প্রবল হওয়ার কারণে পানির উৎসগুলোতে এই জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকারও সহজ নয়। ফলে তারা পানি সংকটে বেশি করে ভোগে। এই পানির অভাবে তাদের পয়:নিষ্কাষণ ব্যবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে দলিত নারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। কারণ,পানি সংগ্রহের পুরো দায়িত্ব নারীর ওপরই বর্তায়। এ ছাড়া শহরাঞ্চলে কলোনিতে যে সাধারণ চৌবাচ্চা আছে সেখানে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক গোসলের ব্যবস্থা না থাকায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার খর্ব হয়। ফলে সে আত্মগ্লানী ও মানসিক হীনমন্যতায় ভোগে;যা তার সুস্থ্য বিকাশের প্রতিবন্ধক। 

দলিত জনগোষ্ঠীর বাসস্থানের যে দুর্দশা,তা বর্ণনা দিয়ে প্রকাশ করা দুরূহ। শহরাঞ্চলে দলিতরা সাধারণত সিটি কলোনী,পৌর কলোনিতে এবং গ্রামাঞ্চলে পুকুর পাড়,রাস্তার ধার এবং খাস জায়গায় খড় এবং কাদা দিয়ে ঘর বানিয়ে নিজেরা একত্রে বসবাস করে। শহরাঞ্চলে সিটি কলোনিগুলোতে দলিতরা ৮/১০ ফুট মাপের একটি ঘরে অন্তত ৩ টি প্রজন্ম বাস করে;যা পুরো মানব সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক। একটি ঘরে তিন প্রজন্ম বাস করা যেমন অস্বাস্থ্যকর,তেমনি মানহানিকর। এতে করে দলিত শিশুদের আত্মসম্মানবোধ ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আরো দুঃখজনক,তারা যদি কোথাও বাসা ভাড়া করতে যায়,পরিচয় পেলে তাদের বাসা ভাড়াও দেয়া হয় না।

সাধারণভাবে দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা নগণ্য। পাশাপাশি দলিত শিশুদের মধ্যে যারা স্কুলে ভর্তি হয়,তারা কখনো শিক্ষক,কখনো আবার সহপাঠীদের দ্বারা এমন সব আচরণ ও বৈষম্যের শিকার হয়;যা তাদের স্কুলে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। এরূপ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও যারা পড়ালেখা শেষ করে তারা শুধুমাত্র জন্মগত পরিচয়ের কারণে উপযুক্ত চাকরি পায় না। এটি ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করানোর ক্ষেত্রে অভিভাবকদের নিরুৎসাহিত করে। এই অবস্থায় দলিত কন্যাশিশুদের শিক্ষা গ্রহণের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। প্রচলিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে যা বোঝায় সেখানে দলিত নারীর কোনো অংশগ্রহণ চোখে পড়ে না। এমনকি সংসারের বাইরে নিকটতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান পঞ্চায়েতেও এক/দু’জন ব্যতিক্রম ছাড়া দলিত নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায় না। 

উপরোক্ত পরিস্থিতি এই জনগোষ্ঠীকে এমন এক জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে,যেখানে তাদের মানবিক মর্যাদা চরমভাবে ভুলুণ্ঠিত। সামাজিকভাবে মর্যাদাহীন,অনিরাপদ ও নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত হয়ে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরেক ধাপ পেছনে থাকা দলিত নারীদের বিকাশের জন্য অবশ্য অতিবিলম্বে দলিতদের প্রতি বিদ্যমান সকল বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতা চর্চা বন্ধ করতে প্রত্যয় ব্যক্ত করে পরো সকল অস্পৃশ্যতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী আইন করতে হবে। 

তাছাড়া, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দলিত নারীদের উন্নয়নে বিশেষ শাখা ও সেল গঠন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগেও অনুরুপ শাখা বা সেল গঠন করে তা কার্যকরী করতে হবে। সেই সাথে শিশু অধিকারভিত্তিক যেসব সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কার্যক্রম চালু আছে সেগুলোতে বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে দলিত কন্যাশিশুদের বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং স্থানীর সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্দেশ জারি করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে অবস্থিত দলিত কলোনিগুলোর আবাসন,পানি ও পয়:নিষ্কাষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে দলিত নারীর জীবনকে বিকাশ যোগ্য করতে হবে। 

লেখক:মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতামহাসচিব, জাস্টিসমেকার্সবাংলাদেশ; মোবাইলঃ ০১৭২০৩০৮০৮০, ইমেল: saikotbihr@gmail.com, ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com

নিবন্ধটি নিম্নোক্ত নিউজ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে:











১১। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন প্রণয়ন জরুরী! NewsBlogBd.Com, February 27, 2013    

======================================================================  
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.