Friday, October 24, 2014

জাত, পাত, পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর

অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকতঃ আমাদের সমাজে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি অবিরত অজস্র বৈষম্যমূলক নিষ্পেষণের ঘটনা ঘটে চলেছে, যা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না বলে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। মহান মুক্তি যুদ্ধের ৪০ বছর পরও আমরা এ সমাজ থেকে জাত-পাত ও পেশা ভিত্তিক বৈশম্য দুর করতে পারিনি। দেশের দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর
৫৫ লক্ষ মানুষ এ দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও এখনো প্রতিনিয়ত জাত-পাত ও পেশা ভিত্তিক বৈষম্যের শিকার হয় এবং সামাজিকভাবে অবহেলিত কতগুলো নির্দিষ্ট পেশা গ্রহনে তাদেরকে বাধ্য করা হয়। 

বাংলাদেশের মহান সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিককে সমান,২৮ অনুচ্ছেদে সকল প্রকার বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা এবং ২৯ অনুচ্ছেদে কর্মক্ষেত্রে সকলের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনা পত্রের ৭ নং ধারা,নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ২ নং ধারা এবং সকল প্রকার বৈষম্য বিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৯ নং ধারায় জাত-পাত ভিত্তিক সকল প্রকার বৈষম্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে  জাতি,ধর্ম,বর্ন ও জন্মগত পরিচয় নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের ঘোষনা থাকলেও এ দেশের দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জনগন এখনো প্রতিনিয়ত নাগরিক, রাজণৈতিক, সামজিক, সাস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়।   

অধিকাংশ মানবশিশু অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম গ্রহন করে। এমন কি গড়ীব পরিবারে যে শিশু জন্ম গ্রহন করে সেও তার পিতা মাতার আর্থিক অবস্থার চেয়ে উন্নতর অবস্থা অথবা অন্তত তা থেকে অন্য অবস্থায় জীবন ধারনের স্বপ্ন দেখার অধিকার রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের দলিত পরিবারের সন্তানের ক্ষেত্রে সে স্বপ্ন আকাশ কুসুম কল্পনা বলে মনে হয়। যদি কোন শিশুর পিতা ঝাড়ুদার হয় তবে সে শিশুটিও যে বড় হয়ে ঝাড়ুদার হবে, তেমনি নাপিতের ছেলেকে বড় হয়ে নাপিত এবং মুচির ছেলেকে বড় হয়ে মুচি হভে এটাই যেন তার চরম নিয়তি। 

অধিকাংশ দলিত সম্প্রদায়ের লোকজনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। একটি স্টাডিতে দেখা যায় যে,৬৪ শতাংশ হিন্দু ধর্মালম্বী দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য এবং ৬১ শতাংশ ইসলাম ধর্মাম্বলী দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য নিরক্ষর। ৮০ শতাংশেরও বেশী দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছে। কিছু দলিত সম্প্রদায়ের শিশুর অভিবাবক শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে শিক্ষক কর্তৃক অনুৎসাহিত করার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। 

উচ্চ বিদ্যালয় বা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পরও সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে তারা কোন চাকুরী পায় না। এমন কি নিম্নস্তরের কাজও পায় না, যা তাদেরকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনে প্রায়শঃ অনুৎসাহিত করে। নিম্ন শিক্ষার হার দলিত সম্প্রদায়ের উন্নয়নে প্রধান বাঁধা এবং তাদের গতানুগতিক পেশা পরিবর্তন করে নতুন পেশা গ্রহনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

শুধুমাত্র পেশাগত কারণেই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় তাদের যে পরিচয় বিনির্মিত হয়েছে আজ পেশা পরিবর্তন করলেও তা সহজে মোচন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এমনকি পেশা পরিবর্তন ও অনেক সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। মুল ধারার জনগোষ্ঠী মনে করে দলিত সম্পদায়ের লোকজন পূর্বে যে পেশায় জড়িত ছিল সেটা তাদের জন্মগত পেশা।ফলশ্রুতিতে তারা স্বভাবতই সমাজ জীবনে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যার সম্মুখীন হয়। 

কোন দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য যদি তাদের গতানুগতিক পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশা গ্রহন করে বা আন্ত: জাত বিয়ে করে বা তাদের সম্প্রদায়ের প্রচলিত নিয়ম কানুন পরিবর্তনে সোচ্চার হয় তবে তারা নিজ সমপ্রদায়ের মধ্যেও বৈষম্যের শিকার হন। যদি তারা কোন ভুলের কারনে দুর্ভোগের শিকার হন,তবে তবে তারা সাধারনত আইনের দৃষ্টিতে সমআচরণ পায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়,যা অনেক সময় স্বেচ্ছাচারী অথবা বৈষম্যের ভিত্তিতেও হয়ে থাকে।

পেশাগত ক্ষেত্রে তারা সমাজের হীন কাজগুলোর সংগেই যুক্ত এবং প্রথম শ্রেনীর চাকুরীতে তো দূরে থাক দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেনীর চাকুরীর সাথে যুক্ত আছে বলেও জানা যায় না। অধিকাংশ দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য নিম্ন বেতনে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সুইপার বা ক্লিনার হিসেবে নিয়োজিত। সরকারি বিভিন্ন ছুটির সময় অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের ছুটি ভোগ করার সুযোগ থাকলেও তাদের ভাগ্যে সেই সুযোগটুকুও মিলে না।

দারিদ্র্য,স্বাস্থ্য,শিক্ষা এবং বাসস্থানের সমস্যা,কর্মক্ষেত্রে অসম সুযোগ,নারীদের প্রতি বৈষম্য,দাসশ্রম এবং শিশুশ্রম দলিতদের জন্য নৈমত্যিক ব্যপার। তাদের নিজস্ব এলাকার বাইরে বসবাসের জন্য কোনো ঘর ভাড়া করতে বা গৃহ নির্মাণ করতে দেওয়া হয় না। দলিত নয় এমন কোনো সম্প্রদায়ের মন্দির বা ধর্মানুষ্ঠানেও তাদের যেতে দেয়া হয় না। পেশাগত কারণে বা অন্য কোন কারণে বাড়ীর বাহিরে থাকলে রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়।

 কিছু রেস্তোরায় তারা প্রবেশের সুযোগ পেলেও অধিকাংশ রেস্তোরায় তারা প্রবেশের সুযোগ পান না এমনকি কারো বাড়িতে,খেলার মাঠে,সিনেমা হলে, মৃতদেহ সৎকারের জায়গায়,কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান বা সঙ্গীতানুষ্ঠানে বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দলিতদের প্রবেশ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। দলিতরা কখনও কখনও অপহরণ, ধর্ষণ, অত্যাচার, বসতবাড়ি উচ্ছেদ ও ধ্বংস,জোরপূর্বক অবৈধভাবে জমির অধিকার হরণ,জমি হতে উচ্ছেদ,ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মত চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। 

দলিত সম্প্রদায়ের জনগণ খুবই অল্প পরিমান জায়গায় মাত্র ১ টি বা ২ টি ঘরে একই গৃহস্থালীর বিভিন্ন প্রজন্মের ১০-১২ জন পর্যন্ত সদস্য এক সংগে বাস করে বা বাস করতে বাধ্য হয়,যা তাদের মানবেতর জীবন যাপনকে নির্দেশ করে। নতুনভাবে ঘর তৈরি করবে বা অন্য কোন জায়গায় তারা জমি ক্রয় করবে সেই সামর্থও তাদের নেই। দেড়শত বছর দেশ সেবা করেও সরকারী খাস জমিতে তারা ব্যক্তি মালিকানা পায়নি। 

চিকিৎসা,শিক্ষা প্রভৃতি সমস্যার পাশাপাশি তারা সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তারা অনেকটাই অরক্ষিত,যে কারণে সেই সমাজে নারীদের শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিছু লোক ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের এলাকায় মাদক ব্যবসার পসার খোলে যা হরিজন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। 

বাংলাদেশে বসবাসরত মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে জাত বৈশম্য,নিম্ন সম্প্রদায়ের প্রতি অষ্পৃশ্যতা ও তাদের বর্জনের মত সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে। দলিতদের নিষ্পেশনের বিষয়টি এতটাই সহজাত যে নিষ্পেষনকারী ও নিষ্পেষনের শিকার উভয়েই তার গভীরতা জানেন,কিন্তু তা কখনো সঠিকভাবে নথিবদ্ধ হয় না বা জনসম্মূখে প্রকাশের আড়ালেই থেকে যায়।

বাংলাদেশে জাত-পাত,অস্পৃশ্যতা ও কর্মভিত্তিক বৈশম্য এত ব্যপক হওয়া সত্বেও যারা এ বিষয়ে চর্চা করে বা রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে এ বিষয়ে খুব কমই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। এমনকি দলিতদের বিরুদ্ধে বৈষম্য নিরসন এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরূপ কার্যকরী ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহনের উদ্যোগ দেখা যায় না। বরঞ্চ সরকার পরিচালিত বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেও বৈষম্য বিদ্যমান দৃশ্যমান হয়। 

বর্তমানে বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অংগনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সদা সচেষ্ঠ, তখন দেশে আন্তর্জতিকভাবে উদ্বেগিত জাতিগত বৈশম্য অনুশিলনে রাষ্ট্র পরোভাবে ইন্ধন দিয়ে চলেছে। যা শুধু বর্তমানে দলিতদের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য অশনি সংকেত। 

তাই দলিত জনগোষ্ঠির মানবাধিকার সুরক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সরকারকে অবিলম্বে দলিতসহ অন্যান্য বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতা চর্চাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষনা করে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করে তার কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে।

লেখক:মানবাধিকারকর্মী,আইনজীবী ও সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব,জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ; ইমেল:saikotbihr@gmail.com, ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com

 নিবন্ধটি নিম্নোক্ত নিউজ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে:

১।জাত, পাত, পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখোঃ সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, BdLawNews.Com, February 05, 2013 

২। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, 52Somachar.Com

৩। জাত, পাত, পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, BanglaNews.Com.Bd, March 01, 2013

৪। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো, UnitedNews24.Com,March 01, 2013

৬। জাত, পাত, পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, TNB24.Com, March 01, 2013

৭। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর,BartaBangla.Com, March 01, 2013

৮। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, Gorai24.Com, March 01, 2013

৯। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, TimesIBengali.Com, March 01, 2013

১০। বৈষম্য রুখে সবার জন্য সমসুযোগ, OpenNews24.Com, March 01, 2013

১১। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, ShesherKhobor.Com, March 01, 2013

১২। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, NewsBlogBd.Com, March 02, 2013

 ১৩। জাত, পাত, পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখোঃ সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, EkusheyNews24.Com, March 06, 2013

 ১৪। জাত,পাত,পেশা ভিত্তিক বৈষম্য রুখো: সবার জন্য সমসুযোগ প্রতিষ্ঠা কর, 52Somachar.Com, March 01, 2013

======================================================================  
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.