Friday, March 14, 2014

বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ: আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই

অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত : একটি সুস্থ জাতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা, বলেছিলেন প্রখ্যাত মনিষী ও দার্শনিক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। অথচ আজ এই একুশ শতকে এসেও বাংলাদেশের ৬৬% মেয়ে এখনো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যার প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে উঠা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও বাল্য বিবাহ একটি বড় বাঁধা। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানতম বাঁধা হিসেবেও বাল্যবিবাহকে চিহ্নিত করা যায়। বাল্য বিবাহের শিকার ছেলে বা মেয়ে সে
যাই হক না কেন সে তার উচ্চ শিক্ষা এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে শিশু শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়। ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশু, কিশোরী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কিশোররাও উন্নত জীবন ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তিগত তথ্য প্রবাহ থেকে বঞ্চিত।

জন্ম মৃত্যু এবং বিবাহ মানব জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ  ঘটনা এর মধ্যে বিবাহিত ব্যক্তির নিজের পছন্দ ও মত প্রকাশের সুযোগ বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের দেশে বেশীর ভাগ বিয়ের ক্ষেত্রেই নারীদের নিজের পছন্দ বা মত প্রকাশের কোন সুযোগ থাকে না। ধর্ম ভেদে বিয়ের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা ভিন্ন।হিন্দু ধর্মে অবিবাহিতা কন্যা পরিবারের অভিশাপ স্বরূপ যেখানে আবার কন্যার পরিবারকে পণ প্রদানের মাধ্যমে কন্যাশিশুর বিবাহের ব্যবস্থা করতে হয়।

পরিবারের বোঝা হ্রাস করার জন্য কন্যা শিশুর বিয়ে দেয়া হয় কিন্তু বাল্য বিবাহের ফলে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ করার ফলে একজন অপ্রাপ্ত বয়সী মার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সংসারের ভার নেবার মত মানসিক পরিপক্কতা না থাকার জন্য সে নানা ধরনের নির্যাতনের মধ্যে জীবন ধারণ করে। এই কন্যা শিশু কখনও কখনও তালাক প্রাপ্তা হয়ে পিতার সংসারে ফিরে আসে এবং তার শিশু সন্তানটিও নতুন করে অসহায় অবস্থায় পরে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০-১৯ বছর বয়সের দুই তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্য বিবাহের শিকার হয়। সেভ দ্যা চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

বিবাহের মাধ্যমেই পরিবার সৃষ্টি হয়। বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষের দাম্পত্য জীবন শুরু করার আইনগত ভিত্তি হলো বিবাহ। বাল্য বিবাহ নারীর আত্ম-উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মনোসামাজিক উন্নয়ন সহ নারীর সার্বিক উন্নয়নে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি  করে।

জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার ২০০৯ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ, যা ২০১১ সালে এসে দাড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে যাদের ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়েছে তাদের শতকরা বর্তমান হার ৬৬, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ।

বাল্যবিবাহ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনেও সহায়ক হয়। যেমন, শিক্ষার আলো এবং স্বাস্থ্যগত কারণে অল্প বয়সের মেয়েটি তার নিজের সম্পর্কে সচেতন নয়, সুতরাং পরিবার সম্পর্কে তার ধারণা না থাকায় স্বাভাবিক বিষয়। ফলে একদিকে সে স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে বুঝে উঠার আগেই সংসার এবং পরিবারের ভারে আক্রান্ত হয়।

অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির থেকেও তার উপর চাপের সৃষ্টি হয়, শুরু হয় অশান্তি, পারিবারিক কলহ, এবং সর্বোপরি পারিবারিক নির্যাতন। আর এই পারিবারিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয় পরিবারের সবায়, বিশেষ করে শিশুরা ভোগে নানা মানসিক অশান্তিতে।

এতে তাড়া লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়, পরিবারের প্রতি জন্মে নানারকম অনীহা, ফলে তাড়া পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানারকম অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে।বাল্য বিবাহের শিকার ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের মত মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হয়, যা তাকে তার সারাজীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ করে।

বিগত কয়েক বছরে শিশু অধিকার বিষয়ক অনেকগুলি  আন্তর্জাতিক সনদ গৃহিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে আন্তর্জাতিক শিশূ অধিকার সনদ, ১৯৮৯ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের নীচের সকল মানবই শিশু। বাংলাদেশের শিশুরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়।

এই সকল নির্যাতনের মধ্যে শিশু শ্রম, যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, পাচার, ধর্ষন, বাল্য বিবাহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধরে নেয়া হয় যে, বিবাহের মাধ্যমেই একটি কন্যা শিশু সকল প্রকার নির্যাতনের হাত হতে রক্ষা পায় এবং তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, বাল্য বিবাহের মাধ্যমে একজন  কন্যাশিশু আরো ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়।

বাল্য বিবাহ একদিকে আইন এবং সংবিধানের লংঘন, অন্যদিকে বাল্য বিবাহের বর ও কনেকে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। যদিও দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী পুরুষের ক্ষেত্রে ২১ বছর পূর্ণ এবং নারীর জন্য ১৮ বছর পূর্ণ হওয়াসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় মেনে চললে তা বৈধ বিবাহ বলে গন্য হয়।

বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ অনুযায়ী কোন এক পক্ষ কর্তৃক উল্লেখিত বয়স পূর্ণ না হলে তা বাল্য বিবাহ বলে গন্য হয় এবং উক্ত বিবাহ ব্যাবস্থাপনার দায়ে ব্যবস্থাপকদের ১ মাসের ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ১ হাজার টাকা অর্থ দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।

যাই হোক বাল্য বিবাহের উদ্বেগজনক এ পরিণতি যেহেতু পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর সেহেতু তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করাসহ আপাময় জনসাধারনকে এ ব্যপারে সচেতন পূর্বক সম্পৃক্ত করতে হবে। আর দেরি নয়, এখনই সময় বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে আসার।

 
লেখক:মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ; মোবাইলঃ ০১৭২০৩০৮০৮০, ইমেল: saikotbihr@gmail.com, ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com

নিবন্ধটি নিম্নোক্ত নিউজ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে:

১। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ:আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই, BanglaNews24.Com, December 17, 2012

২। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই, JatioBarta.Com, December 19, 2012

৩। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানতম বাধা হচ্ছে বাল্যবিবাহ, BdLawNews.Com, December 31, 2013  

৪। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই, UNSBd.com, March 26, 2013

৫। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই, Bangla.Se, March 26, 2013

৬। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ: আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই, 52 Somachar.Com, March 26, 2013

৭। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ: আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই, Ajker24.Com, April 5, 2013

======================================================================  
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.