Sunday, July 22, 2012

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ১৯ তম অধিবেশন:গৃহীত প্রস্তাবনাসমূহ

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ১৯ তম অধিবেশন গত ফেব্রুয়ারী ২৭ থেকে মার্চ ২৩, ২০১২ ইং তারিখে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনে মানবাধিকারের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে পর্যাপ্ত বাসস্থান; সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার; সংখ্যালঘু অধিকার; যৌন এবং লিঙ্গগত পরিচয়; খাদ্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং কিশোর ন্যায়বিচারের মত বিষয়গুলো আলোচিত ও পর্যালোচিত হয়।

মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত উক্ত অধিবেশনে সরকারের মন্ত্রী এবং প্রতিনিধিগণ সিরিয়া, ইরান, শ্রীলংকা, উত্তর কোরিয়া, মায়ানমার সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার বিষয়ক স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক বিভিন্ন বিষয়ের উপস্থাপিত প্রতিবেদনসহ ৮০ টি প্রতিবেদনের উপর কার্যকর আলোচনা, সাধারণ বিতর্ক এবং প্যানেল আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করে নিম্নোল্লিখিত প্রস্তাবনাসমূহ করা হয়।

সিরিয়া

২০১২ ইং সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ১৯ তম অধিবেশনে গৃহীত রাষ্ট্র ভিত্তিক নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা সিরিয়ার সরকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাধারণ নাগরিকের উপর মাত্রারিক্ত বলপ্রয়োগ, স্বেচ্ছাচারমূলক অন্তরীন রাখা ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কার্যকর করা, বলপূর্বক গুম, যৌন নির্যাতন, আবাসিক এলাকার ধ্বংস সাধন, জরুরী ঔষধ, খাদ্য এবং জ্বালানী সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে। উল্লেখিত প্রস্তাবনা পক্ষে ৪০ টি রাষ্ট্র এবং বিপক্ষে ৩ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়। এ সময় ৩ টি রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকে এবং ৪ টি রাষ্ট্র অনুপস্থিত থাকে। এই প্রস্তাবনা সিরিয়ার চলমান সকল প্রকার সহিংসতা, মানবাধিকার লংঘন জরুরী ভিত্তিতে বন্ধ করা, সকল রাজবন্দীর মুক্তি, অবরুদ্ধ শহর সমূহ থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লংঘনের বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক, স্বচ্ছ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত কার্য পরিচালনার দাবি করে। ইহা তদন্ত কমিশনের ম্যান্ডেট বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে এবং ২০১১ ইং সালের মার্চ মাস থেকে চলমান মানবাধিকার লংঘনসমূহের নিয়মিত হালনাগাত তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমিশনকে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ যদিও এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দান করে কিন্তু গৃহীত প্রস্তাবনাটি অসম্পূর্ন এবং আরো বেশী ভারসাম্যমূলক হওয়া উচিত ছিল বলে বাংলাদেশ নোট প্রদান করেন। অস্ট্রেলিয়া যদিও কাউন্সিলের সদস্য নয়, তবু সিরিয়ান সরকার ও সকল দলসমূহকে সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধ এবং দুর্গত এলাকায় জাতিসংঘ মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারী ও জরুরী ত্রাণ সমন্বয়ককে পরিদর্শনের অনুমতি প্রদানের আহবান করেন। যুক্তরাজ্য কাউন্সিলের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও সিরিয়ার উপর গৃহীত সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবনায় জোড় সমর্থন জানান এবং সিরিয়ায় সংঘঠিত বর্বরতার জন্য দায়ীদের বিচারের সম্মুখীন করার জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাক্ষ্য সংগ্রহ করার কাজে কাউন্সিলকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।

শ্রীলংকা

লেসন এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (এলএলআরসি) শ্রীলংকার আন্তর্জাতিক আইনের সিরিয়াস লংঘনসমূহ সঠিকভাবে এড্রেস করতে পারেনি বলে গৃহীত এই প্রস্তাবনা উল্লেখ করেছে । ইহা শ্রীলংকান সরকারকে এলএলআরসি’র প্রতিবেদনের গঠনমূলক সুপারিশ সমূহের দ্রুত বাস্তবায়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কি কি কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনাসহ অভিযুক্ত আন্তর্জাতিক আইনের লংঘনসমূহের বিষয়ে সুপারিশ সমূহের কার্যকর বাস্তবায়নের আহবান করে। এই প্রস্তাবনা শ্রীলংকা সরকারকে মানাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনারের কার্যালয়ের সাথে যৌথভাবে কাজ করার আহবান করে। এই প্রস্তাবনা পক্ষে ২৪ টি রাষ্ট্র এবং বিপক্ষে ১৫ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং ৮ টি রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকে।

ইরান

এই প্রস্তাবনা ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক ইরান এর মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদকের কার্য মেয়াদ আরো এক বছরের জন্য বৃদ্ধি করে। ইহা বিশেষ প্রতিবেদকে তথ্য প্রদান করে সহযোগীতা করার জন্য ইরান সরকারকে অনুরোধ করে। এই প্রস্তাবনা পক্ষে ২২ টি রাষ্ট্র এবং বিপক্ষে ৫ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং ২০ টি রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকে।

উত্তর কোরিয়া

এই প্রস্তাবনা উত্তর কোরিয়ায় চলমান চরম, ব্যপক ও নিয়মিত মানবাধিকার লংঘনসমূহের বিষয়ে কাউন্সিল উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং এ বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদকের ম্যান্ডেট আরো এক বছর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি কোন ভোটাভোটি ছাড়া সর্বসম্মতিতে গৃহিত হয় এবং কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোন সুপারিশ বা মন্তব্য করেনি।

মায়ানমার

এই প্রস্তাবনায় মায়ানমারের সাম্প্রতিক সময়ের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানানো হয় এবং মায়ানমার সরকারকে ১ এপ্রিল ২০১২ ইং তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদের উপনির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা নিশ্চিত করা এবং সার্বজনীন পর্যায়বৃত্ত পূণরীক্ষন ও বিশেষ প্রতিবেদকের সুপারিশসমূহ এবং মানবাধিকার কাউন্সিল ও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবনা সমূহের বান্তবায়ন চালু রাখার আহবান জানান। এ প্রস্তাবনা বিশেষ প্রতিবেদকের ম্যান্ডেট আরো এক বছরের জন্য বৃদ্ধি করে। প্রস্তাবনাটি কোন ভোটাভোটি ছাড়া সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।

অবৈধ অর্থ উৎস রাষ্ট্রের নিকট প্রত্যাবর্তন না করায় মানবাধিকারের ক্ষেত্রে নেগেটিভ প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উন্নয়ন

এই প্রস্তাবনা সকল রাষ্ট্র, যারা জাতিসংঘ দূর্নীতির বিরুদ্ধে কনভেনশন এখনো অনুমোদন করেনি, তাদের এই কনভেনশনটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করার আহবান জানান। প্রস্তাবনাটি পক্ষে ৩৫ টি রাষ্ট্র, বিপক্ষে ১ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং ১১ টি রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকে। কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোন সুপারিশ বা মন্তব্য করেনি।

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মী বিন্যাস

এই প্রস্তাবনা মানবাধিকার হাই কমিশনারকে তার কর্মী সুবিন্যস্তকরণ যে সকল রাষ্ট্র ও অঞ্চল প্রতিনিধিত্বে পিছিয়ে রয়েছে, বিশেষত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ, তাদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি এবং যেসব রাষ্ট্র ও অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব ইতোমধ্যে আনুপাতিক হারে বেশি রয়েছে তাদের নতুন করে প্রতিনিধি গ্রহণে শূন্য মান বজায়ের মাধ্যমে সম ভৌগলিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করার আহবান করে। প্রস্তাবনাটি পক্ষে ৩৩ টি রাষ্ট্র, বিপক্ষে ১২ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং ৩ টি রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকে। কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোন সুপারিশ বা মন্তব্য করেনি।

মানবাধিকার এবং একতরফা নিগ্রহমূলক ব্যবস্থা

এই প্রস্তাবনা সকল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং আন্তরাষ্ট্রীয় শান্তিপূর্ন সম্পর্কের নিয়ম অ নীতিগুলোর সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন একতরফা নিগ্রহমূলক ব্যবস্থা গ্রহন অথবা বাস্তবায়ন বন্ধের আহবান করে। প্রস্তাবনাটি পক্ষে ৩৫ টি রাষ্ট্র, বিপক্ষে ১২ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয় । কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোন সুপারিশ বা মন্তব্য করেনি।

উন্নয়নের অধিকার

এই প্রস্তাবনা মানবাধিকার হাই কমিশনারের কার্যালয়কে উন্নয়নের অধিকারের ব্যপারে উত্সাহ দান ও তা সিদ্ধি করা সংক্রান্ত তার কার্যক্রমের একটি বার্ষিক প্রতিবেদন কাউন্সিলের নিকট পেশ করার আহবান করে। প্রস্তাবনাটি পক্ষে ৪৬ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয় । কোন রাষ্ট্র এ প্রস্তাবনার বিপক্ষে ভোট প্রদান না করলেও ১ টি রাষ্ট্র ভোট প্রদানে বিরত ছিল। কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোন সুপারিশ বা মন্তব্য করেনি।

মানবাধিকার, গনতন্ত্র এবং আইনের শাসন

এই প্রস্তাবনা সকল মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ গণতন্ত্রের উপর জোর গুরুত্ব আরোপ করে। রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক মানবাধিকারের প্রেক্ষিতে গনতন্ত্র নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণকালে যে সকল সাধারণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন, সে বিষয়ে প্যানেল আলোচনা এবং একই বিষয়ে একটি খসড়া স্টাডি করার জন্য মানবাধিকার হাই কমিশনারকে আহবান করে। প্রস্তাবনাটি পক্ষে ৪৩ টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয় । কোন রাষ্ট্র এ প্রস্তাবনার বিপক্ষে ভোট প্রদান না করলেও ২টি রাষ্ট্র ভোট প্রদানে বিরত ছিল। কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোন সুপারিশ বা মন্তব্য করেনি।

সূত্রঃCountry-Specific Resolutions Adopted by the UN Human Rights Council at its 19th session- 27 February to 23 March 2012.

======================================================================  
Personal site of Advocate Shahanur Islam (an young, ascendant and promising human rights defender and lawyer) working for ensuring human rights, rule of law and social justice in Bangladesh and the Globe. কপিরাইট © অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত. সকল সত্ব ® সংরক্ষিত. শাহানূর ডট ব্লগস্পট ডট কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোন নিবন্ধ, মতামত, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ব্যতীত ব্যবহার আইনগত দণ্ডনীয়.

No comments:

Post a Comment