আশুলিয়ার পোশাক কারখানায় সাম্প্রতিক কালে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলনের
বিষয়ে বেশ কিছুদিন যাবত বিভিন্ন পত্রিকা, ফেসবুক, ব্লগসহ বিভিন্ন টিভি
চ্যানেলে এ আন্দোলনের যৌক্তিকতার পক্ষে বিপক্ষে সরগরম আলোচনা চলছে। বিভিন্ন
আলোচনার মধ্যে বরাবরের মত এ আন্দোলনের পিছনে পোশাক শিল্প ধ্বংসের সুদূর
প্রসারী ষড়যন্ত্র, বহি:শক্তির ইন্ধন ইত্যাদি বিষয়গুলো জোড়সরে উঠে এসেছে।
বিশেষ করে সরকার ও পোশাক শিল্প মালিকগন মিডিয়ার সহযোগিতায় ‘ষড়যন্ত্র
তত্ত্ব’ হাজির করে মিথ্যা প্রচারনার মাধ্যমে শ্রমিকদের নায্য সংগ্রামকে
কালিমা লিপ্ত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতীতেও বিভিন্ন সময় শ্রমিক
আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারনা ছিল। কিন্তু এবার গার্মেন্টস মালিক ও সরকার
প্রচারনা কৌশলকে সংগঠিত রূপ দিয়ে প্রতিযুদ্ধের আকারে হাজির করেন।
এ দেশে গার্মেন্টস খাতে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার না থাকলেও মালিকদের
সংগঠন রয়েছে। সেই সংগঠন বিজিএমইএ আন্দোলনের মূল ইস্যু থেকে দেশবাসীর
দৃষ্টি সরাতে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ কে সামনে নিয়ে এসেছে। তারা আশুলিয়ার
পোশাক কারখানায় সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলনের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে বিভিন্ন
এনজিও, বহি:বিশ্ব ও কতিপয় রাজনৈতিক দলকে উল্লেখ করতে থাকে। এ দাবীর পে
তারা অবশ্য এখনো পর্যন্ত কোন প্রমান হাজির করতে পারেনি। কিন্তু এ দেশের
মানুষের মনোজগতে ক্রিয়াশীল এনজিও, বহি:বিশ্ব ও কতিপয় রাজনৈতিক দল বিদ্বেষ
সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছে তারা।
বিজিএমইএ ও সরকার স্বত:স্ফূর্ত শ্রমিক আন্দোলনের পিছনে বিভিন্ন এনজিও,
বহি:বিশ্ব ও কতিপয় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আবিষ্কারের যেভাবে চেষ্ঠা করেছে
সেটা এ দেশের এক পুরনো খেলা। পাকিস্তান আমল থেকে জনমানুষের নানা নায্য
আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার জন্য এভাবে বিদেশী ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে ব্যবহার করা
হয়েছে। এক সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকেও ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে
অভিহিত করা হত। কিন্তু বিপুল রাজাকারদের ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও যেমন
বৈষম্যের বোধ বাঙ্গালিকে ১৯৭১ সালে অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য করেছিল, তেমনি
বিজিএমইএ ও সরকারের নিবির তথ্য সন্ত্রাস সত্ত্বেও আশুলিয়া আন্দোলন গড়ে
উঠেছিল মূলত সীমাহীন মজুরী বঞ্চনার কারনে। গার্মেন্টস শিল্পে সর্বত্র কর্ম
পরিবেশ এতো বেশী খারাপ এবং মজুরী এতো কম যে, তীব্র বঞ্চনাবোধ থেকে কিশোর ও
সদ্য তরুন শ্রমিকরা সর্বত্র র্যাব, পুলিশ এবং মালিকদের পেটোয়া বাহিনীর
দমন-পীড়ন অগ্রাহ্য করে অভূতপূর্ব প্রতিরোধের জন্ম দেয়।
মধ্যবিত্তের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে শ্রমিক জীবনের প্রতি
বরাবর নিষ্পৃহ, উদাসীন। শ্রমিকদের ভাংচুরে ছন্দপতনের শিকার মধ্যবিত্ত
নাগরিক অভিব্যক্তিতে শ্রমিকদের দু:খ সংগ্রামের চেয়ে পোশাক রপ্তানী বাবদ
আসা বৈদেশিক মুদ্রার যোগান নিরবিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।
এসময় মধ্যবিত্তের এ উদ্বেগে ইন্ধন দেয় মালিকদের সূক্ষ্ম প্রচারণা।
এটা সত্য যে, সা¤প্রতিক আন্দোলনে শ্রমিকদের মাঝে নৈরাজ্যবাদী প্রবণতা
ছিল স্পষ্ট। কিন্তু এটাও সত্য যে, ম্যানেজমেন্ট এর কাছে শ্রমিকদের ােভের
কথা তুলে ধরার কোথাও কোন অবকাঠামো নেই। শ্রম আইনে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার,
নেতৃত্ব নির্বাচনের যতো অধিকার আছে- সবই গার্মেন্টস মালিকরা অলিখিতভাবে
নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কোন শ্রমিক কর্তৃক কোন অভিযোগ তুলে ধরা মানেই
চাকুরিচ্যুত। নৈরাজ্যই ছিল যেন এগুলোর প্রতিউত্তর।
আশুলিয়ার পোশাক কারখানায় সা¤প্রতিক কালে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলন ছিল
পুরোদস্তর চিরায়ত ধাঁচের একটি শ্রেনী সংগ্রাম। এই শ্রেনী সংগ্রামের ফলাফল
এখনো শ্রমিকদের পে নয়। এটা অস্বাভাবিকও নয়। অপরিনত ও অপরূপ একটি শ্রমিক
গোষ্ঠী বহু ধুরন্ধর দানবের বিরূদ্ধে লড়ছে। কিন্তু শ্রেনী সংগ্রামের এই
পর্বে প্রাপ্তিও কম নয়। বিশেষ করে তা শ্রমিকদের শত্রু“-মিত্র চিহ্নিত করতে
ভীষন সহায়ক হবে-যদি আদৌ বাংলাদেশের শ্রমজীবীরা তা চিহ্নিত করতে আগ্রহী
হন।
No comments:
Post a Comment